আজ হতে ২৬বছর আগের চিঠি।
তখন আমি দশম শ্রনীতে। মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় উড়ন্ত এক কিশোর। আকাশ ছোয়াবার রঙিন স্বপ্ন। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই প্রতিকুল। আজ শুধু স্মৃতি।
-------------------------**
স্নেহের মরাচেঙ্গী১৪/৮/৮৯
আলোময়,
আমার স্নেহাশীষ নিও। ভাল আছ তো? আমিও তাই বলে জেনো। তোমার পাঠানো খাতা সহ চিঠিটি পেয়েছি যথা সময়ে। তোমার সাহিত্য প্রতিভা সত্যি স্ব-জাতি ও স্ব-সংস্কৃতির প্রীতির দাবী রাখে। শিশুশ্রেণী থেকে বেজাতি ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে আমরা ওতপৌরত জড়িত। ফলে আমাদের শিক্ষার্থী বা শিক্ষিতরা পর সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়ে। মনে রাখতে হবে কোনো একটা জাতি বা সম্প্রদায়কে ধ্বংস করতে হলে আগে গলা টিপে ধরতে হবে সেই জাতির সংস্কৃতির উপর। একজন বোবা লোককে যেমন তীব্র আঘাত করলেও সে ব্যাথার কথা উচ্চ স্বরে অন্যকে জানাতে পারবেনা বা প্রতিবাদি কন্ঠ জোরদার করতে পারবেনা, তেমনি কোনো একটা জাতির সংস্কৃতি বা ভাষাকে যখন তিলে তিলে ধ্বংস করা হবে তখন তাকে আঘাত করলেও সে আর চিৎকার করে কিছু বলতে পারবেনা। তখন তার ধ্বংস ছারা আর গত্যন্তর থাকবেনা।
এ ক্ষেত্রে মধ্য জাপানের একটি সংখ্যা লঘু জাতির কথা মনে পড়ছে। সে সংখ্যা লঘু জাতিটির কথা বর্তমান দুনিয়ায় ক'টি মানুষই বা জানে? কেননা সেই জাতির বিরুদ্ধে কেহ যুদ্ধও করেনি তারাও কোনো প্রতিবাদও করেনি। কিন্তু সে রকম কোনো কথা না থাকলে সেই জাতিটার অস্থিস্ত্ব আমি পেলাম কোথায়? এটা বানোয়াট বা আদৌ মিথ্যা নয়। জাপানীরা সুকৌশলে সেই
২য় পৃষ্টা
-------
জাতির অস্তিস্থ পৃথিবী থেকে বিলোপ করে দিয়েছে। কিন্তু তারা সেটা করলো কি করে? হে তার তত্বে পায় জাপানীরা যুগ যুগ ধরে সেই সংখ্যা লঘু জাতিটির উপর সংস্কৃতি গত শোচন চালিয়েছিল। সেই জাতির সংস্কৃতির উপর জাপানীরা এমনভাবে প্রভাব খাটিয়েছিল যার ফলে সেই জাতির সংস্কৃতি ক্রমান্বয়ে ধ্বংসে পর্যবসিত হয়। সংস্কৃতি ধ্বংস হওয়া মানেই জাতির কন্ঠ রুদ্ধ হওয়া, বিলুপ্ত হওয়া। আর তাদের অবস্থা হয়েছিল ও তাই। মধ্য জাপানের সেই সংখ্যা লঘু জাতিকে আজ জাপানীরা পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছে। তাদের কথা কেউ আর জানেনা। কেউ বাহির জগতে শুনতে পায়নি তাদের কন্ঠ ধ্বনি, তাদের করুন কান্না। কারন তারা কাদঁতে পারেনি চিৎকার করে, কিছুই বলতে পারেনি। কেননা জাপানীরা প্রথমেই সুকৌশলে তাদের গলা টিপে ধরেছিল, অর্থাৎ সংস্কৃতির বিলোপ সাধন করছিল। আজ কারাও জাপানী।
মনে রাখতে হবে যে, দুর্বলের উপর সবলের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা পৃথিবীব্যাপী। মানুষের আশার যেমনি অন্ত নেই তেমনি পাপ পূর্ণ হৃদয়ের ও দুরাশার নিবৃতি নেই ইতি নেই। যতই কার্য সিদ্ধি ততই দুরাশার শ্রী বৃদ্ধি। কোন একটা সবল জাতিও কোনো একটা ক্ষুদ্র জাতির উপর শুধু প্রভাব বিস্তার করে কান্ত হয়না, সে চায় পুরোপুরি গ্রাস করতে, নিজ জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি করতে। আর এই আগ্রাসী মনোভাব
৩য় পৃষ্টা
---------
দুনিয়ার সমস্ত বড় বড় জাতি সমূহের মনে তীব্র ভাবে বিরাজ করছে। তাই ক্ষুদ্র জাতি সত্বা সমূহের সেই আগ্রাসন থেকে মুক্ত থাকার চেস্টা থাকতে হবে। নিজ জাতি সত্বাকে প্রভূত সম্মান দিয়ে তার অস্থিস্ত্ব রক্ষার কাজে ব্রতী হওয়া প্রতিটি চেতনাবান লোকের আদর্শ দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে যে অল্প শিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিত সবাই অন্য জাতির ভাষা বা সংস্কৃতির প্রতি যতটুকু আসক্ত নিজ ভাষা বা সংস্কৃতির প্রতি ততটুকু সম্পৃক্ত নয়। অন্য জাতির ভাষায় কথা বলতে পারলে তারা নিজেকে গর্বিত মনে করে। কিন্তু স্ব জাতি ভাষা যে সেখানে হামাগুরি খেয়ে মরছে তা ভেবে তারা একটুও লজ্জাবোধ করেনা। সংস্কৃতি যখন লুপ্ত হয়ে যাবে তখন জাতীয় অস্থিস্ত্ব ও যে আর টিকে থাকতে পারবেনা সে কথা আমাদের শিক্ষিত মহল কোন দিন ভাবছে কি? আমাদের এই অসচেতনতা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
প্রিয় আলো, তুমি আমার চেয়ে বয়সে ছোট হলেও তোমার স্বজাতির সাহিত্য প্রতিভা বা সাহিত্য চর্চা বিষয়ে আমি তোমাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারিনা। তোমার রচিত বেশ ক'টি কবিতা আমি পড়েছি।
৪র্থ পৃষ্টা
--------
সেখানে যদিও বা ভাষা এবং বানানগত অনেক ভুল রয়েছে তবুও সেই কবিতা গুলোর মাঝে তোমার স্বজাতি সংস্কৃতির প্রতি যে শ্রদ্ধা ও মমতা মিলেছে তা বলবার নয়। ব্যক্তিগত ভাবে আমারও বেশ কয়েক ডজন স্বরচিত চাকমা কবিতা রয়েছে। শুধু কবিতা নয় বেশ কিছু গান ও একটি অসমাপ্ত নাটকও রয়েছে। কিন্তু কি করি ভাই, জাতিগত ভাবে আমাদের অবস্থানের কথা তোমারও অজানা নয়। আমরা যে যুগ যুগ ধরে অবহেলিত, প্রভাবিত (অন্য জাতি দ্বারা) ও অধঃপতিত তা তোমার নিশ্চয় জানা আছে বলে মনে হয়। জানো তো আমরা অর্থনৈতিক ভাবে জর্জরিত। মোট কথা বলতে গেলে আমরা সবদিকে পশ্চাৎপদ। এই পশ্চাৎপদতা আমাদের জাতীয় অভিশাপ। একটা ৭০/৮০ পৃষ্টা বই ছাপাতে কম করে হলেও ১২/১৪ হাজার টাকার নিতান্তই প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের আর্থিক অবস্থা এতই নড়েবরে যে যেন নুন আনতে পানটা ফুরায়। অর্থনীতিই আমাদের সব অগ্রগতির পথে প্রতি বনন্ধক। এই প্রতি বন্ধকতা যত দিন দূর না হবে অর্থাৎ যত দিন না আমাদের জাতীয় অর্থনীতি চাঙা না হয় ততদিন
৫ম পৃষ্টা
--------
তেমন কিছু ভাবা যায়না। এদিকে নানিয়ার চরের বর্তমান অবস্থা ও তোমার অজানা নয়। আমাদের কজমা অফিস ও ঠিক ভাবে চলছে না। কারন নানিয়ার চরের বর্তমান অবস্থা যা দাড়িয়েছে তা বলার নয়। কাজেই অবস্থার প্রেক্ষিতে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। ঐ দিকে যে একটা সংকলন প্রকাশ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল তাও আআপাততঃ মুলতবি। যেহেতু টাকা যোগাড় করাটা এত সহজ নয়।
যাক তোমার কবিতার খাতাটি আমার হাতে আছে। বর্তমানে আমাদের ২য় সাময়িক পরীক্ষা চলছে। তাই তোমার কবিতা গুলি দেখার সময় পাচ্ছি না। কয়েক দিন পর অর্থাৎ পরীক্ষা শেষ হলে পরে তোমার খাতাটি অবশ্যই দেখবো। আবারও স্নেহাশীষ।
ইতি
তোরই আনন্দ দা
১৪/৯/৮৯
___________
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন